সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ও তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ তিনটি দেশে পাওয়া...
সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ও তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান |
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ তিনটি দেশে পাওয়ার তথ্য উদ্ঘাটন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাইফুজ্জামান, তার স্ত্রী রুখমিলা জামান, যিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এবং তাদের মেয়ে জেবা জামানের নামেও এই সম্পদের হিসাব রয়েছে। সাইফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করা অর্থ দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন এবং ফ্ল্যাট কিনেছেন। এসব দেশে তার ব্যবসা জমি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তার নগদ অর্থও রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে শিগগিরই অর্থ পাচারের অভিযোগে সাইফুজ্জামান এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত ২৮ ডিসেম্বর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে সম্পদ থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধানে নামে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচারের বিষয়ে জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠায়। এতদিন এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরব ছিল, তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গতকাল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সাইফুজ্জামান এবং তার পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে। একই দিন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের পরিবারের অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করা হয়। এর আগে রোববার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং তার পরিবারের অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করা হয়েছিল। এছাড়া, কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিক ব্যাংক থেকে কোনো অঙ্কের টাকা উত্তোলন করলে তা জানাতে বলা হয়েছে, এবং চলতি সপ্তাহে কেউ এক দিনে ২ লাখ টাকার বেশি উত্তোলন করতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান আইনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ২১টি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বা তার পরিবারের কারও নাম সেই তালিকায় নেই। সাইফুজ্জামান, যিনি চট্টগ্রাম-১৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন, তার নির্বাচনী সম্পদ বিবরণীতে বিদেশে কোনো সম্পদের উল্লেখ ছিল না।
জানা গেছে, সাইফুজ্জামান ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার শুরু করেন। সেখানে তিনি "নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড" নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি বিভিন্ন সময়ে ৯টি প্লট বা ফ্ল্যাট কেনেন। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে, তার মালিকানাধীন "জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি" নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিডি ব্যাংকে ৪৫,৩৪০ ডলার জমা হয়। এই টাকার মধ্যে ২৩,৮৯০ ডলার আসে ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক থেকে এবং ২১,৪৫০ ডলার আসে ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম লিমিটেড থেকে, যা এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে জমা হয়।
এছাড়া, সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান, "আরামিট প্রপার্টিজ এলএলসি" এবং "জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি," এর পক্ষে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ডলার নগদে জমা হয়। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট আমেরিকা টাইটেল ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে সিটিআর হিসেবে রিপোর্ট করা হয়।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচার শুরু করেন বলে জানা গেছে। সেই বছর, ৮ ফেব্রুয়ারি, তিনি প্রথমে "র্যাপিড র্যাপ্টর এফজিই" নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন, যা কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসার জন্য ছিল। এরপর, ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ভবন নির্মাণ এবং নির্মাণসামগ্রী বিক্রির জন্য তিনি "জেবা ট্রেডিং এফজিই" নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
গত বছরের শেষদিকে, তার স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় "কিউ গার্ডেন্স বুটিক রেসিডেন্স-ব্লক বি" তে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়। একটি ফ্ল্যাট ১৫ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ দিরহামে এবং অন্যটি ৩০ নভেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৬৯ দিরহামে কেনা হয়।
সাইফুজ্জামানের নামে দুবাই ইসলামী ব্যাংকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এছাড়াও, ফার্স্ট আবুধাবী ব্যাংকে তার একটি দিরহাম অ্যাকাউন্ট এবং একটি ডলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর জনতা ব্যাংকের আমিরাত শাখায়ও একটি দিরহাম অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এই সব অ্যাকাউন্টে বর্তমানে মোট ৩৯ হাজার ৫৮৩ দিরহাম এবং ৬ হাজার ৬৭০ ডলার জমা রয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর লন্ডনে আটটি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর মোট বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ড, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও, তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামেও সেখানে কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরামিটের অধীনে একটি কোম্পানি আছে বলেও জানা গেছে।
সাইফুজ্জামান ২০১০ সালের ১৩ জুলাই লন্ডনে প্রথম "নিউ ভেঞ্চার (লন্ডন) লিমিটেড" নামে একটি কোম্পানি খোলেন, যার মূল ব্যবসা বাড়িঘর কেনাবেচা। এই কোম্পানির স্থায়ী ও চলতি সম্পদের মূল্য ১ কোটি ১৭ লাখ পাউন্ড। এরপর, ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি "জেডটিএস প্রপার্টিজ" নামে আরেকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সম্পদমূল্য ৭ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ড।
২০১৯ সালের ৬ জুলাই তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে "রুখমিলা প্রপার্টিজ" নামের একটি কোম্পানি খোলেন, যার সম্পদের মূল্য ২ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড। এছাড়া, ২০২০ সালের ৬ মে "আরামিট প্রপার্টিজ" নামে আরেকটি কোম্পানি খোলেন, যার সম্পদ ২ কোটি ১৫ লাখ পাউন্ডের। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই প্রতিষ্ঠিত "জেডটিজেড প্রপার্টিজ" এর সম্পদমূল্য ২ কোটি ৯৯ লাখ পাউন্ড।
তাঁর মেয়ে জেবা জামানের নামে ২০২১ সালের ২১ জুন "জেবা প্রপার্টিজ" নামে একটি কোম্পানি খোলা হয়, যার সম্পদমূল্য ১ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড। আরেকটি কোম্পানি, "জারিয়া প্রপার্টিজ," এর সম্পদ ৬০ লাখ পাউন্ডের। সর্বশেষ, ২০২১ সালের ২২ জুলাই তিনি "সাদাকাত প্রপার্টিজ লিমিটেড" নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সম্পদমূল্য প্রায় ২ কোটি পাউন্ড।
সরকার পরিবর্তনের পর একের পর এক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গতকাল সোমবার, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, তাঁর স্ত্রী এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুখমিলা জামান চৌধুরী, এবং তাঁদের সন্তানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেশের সব ব্যাংককে চিঠির মাধ্যমে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এছাড়া, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তাঁর স্ত্রী শারমিন মুশতারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টও একইভাবে ফ্রিজ করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইফুজ্জামান ও আরাফাত পরিবারের মালিকানাধীন যেকোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করতে হবে। ফলে, এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তারা কোনো অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন না। এই পদক্ষেপ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যে স্থগিতকৃত অ্যাকাউন্টের তথ্য, যেমন অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম, কেওয়াইসি এবং লেনদেন বিবরণী জমা দিতে বলা হয়েছে।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"