যখন কোনো স্থানে দাঙ্গা বা জনরোষ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং পুলিশ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন 'সান্ধ্য আইন' জারি করা হয়। ত...
যখন কোনো স্থানে দাঙ্গা বা জনরোষ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং পুলিশ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন 'সান্ধ্য আইন' জারি করা হয়। তবে আমরা সাধারণত এটি 'কারফিউ' নামে চিনি। চলমান কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশে কারফিউ জারি করা হয়।
আধুনিককালে এই আইনের অধীনে চার জনের বেশি মানুষ কোনো পাবলিক প্লেসে একত্রিত হতে পারেন না। এর ফলে শহর এবং গ্রামের জনজীবনে গত এক সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। কারফিউ চলাকালীন দেশের মানুষের অবস্থা কেমন ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি আমরা।
আমি এক দুর্যোগময় পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম
কারফিউ চলাকালীন আমি লেকায় নিজ বাসায় অবস্থান করছিলাম। প্রতিটি দিনই ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ভরা। বাইরে কী ঘটছে তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়া না থাকায় কোনো খবরও ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল না। এর আগে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল করোনার লকডাউনের সময়, কিন্তু তখন অন্তত ইন্টারনেট বন্ধ ছিল না। এবার সোশ্যাল মিডিয়া না থাকায় বাইরে যোগাযোগ করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফলে পরিস্থিতি ছিল আরও কঠিন।
ইন্টারনেট শুধু ফেসবুক আর ইউটিউব দেখার জন্য নয়। এটি এখন আমাদের যোগাযোগ ও বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম, অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির উপায়। এটা আমাদের জীবনযাত্রার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইন্টারনেট ছাড়া সময়টা খুবই কঠিন ছিল।
আমি বলতে চাই, এই কয়েকটা দিন এক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে ছিলাম। আমার বিশ্বাস, পুরো দেশের মানুষও একই অবস্থায় ছিল। দুর্যোগ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সবার মনে এখনো ভয়-ভীতি কাজ করছে। আশা করছি, আমাদের জীবনযাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হবে। যত দ্রুত সেই পরিস্থিতি কেটে যায়, ততই সবার জন্য মঙ্গল।
— চঞ্চল চৌধুরী, অভিনেতা
শেষ কয়েকদিনে আমি বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম
ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা বিষয়টি নিয়ে জানতে শুরু করি। প্রথমে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি এবং আমার সহপাঠীরাও আমাকে পুরো বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করেছিল। তবে শেষ কয়েকদিনে বেশ চিন্তিত ও আতঙ্কিত হয়ে উঠি। যদিও আমি সরাসরি আন্দোলন দেখিনি, তবুও সহপাঠী, সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলাম।
কারফিউ জারি হওয়ার পর আমি হোস্টেলেই অবস্থান করি। হোস্টেল থেকে বের হওয়াও এক প্রকার নিষেধ ছিল এবং এর ফলে আমি কোনো সহিংসতা প্রত্যক্ষ করিনি। যখন ইন্টারনেট বন্ধ করা হলো, তখন কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। তবে মালয়েশিয়ান হাই কমিশন ও আমার কলেজের অধ্যক্ষের সহায়তায় আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হই। আমার পরিবার চাইছিল আমি দেশে (মালয়েশিয়া) ফিরে যাই।
মালয়েশিয়ান হাইকমিশনের সহযোগিতায় মঙ্গলবার আমি সহ ১৯ জন শিক্ষার্থী নিরাপদে দেশে ফিরে আসি। হোস্টেল থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল এক যুদ্ধপরিস্থিতি। রাস্তায় ট্যাংকার এবং সশস্ত্র পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের টহল দিতে দেখছিলাম। যা আমার জন্য বেশ ভয়ানক ও নতুন অভিজ্ঞতা ছিল।
— ক্যাসান্দ্রা ডেভিড
মালয়েশিয়ান শিক্ষার্থী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
রিকশাচালকের জীবনেও চলছে কারফিউ
রিকশাচালক খায়ের আলী বলেন, "রাস্তায় না বের হলে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবো কীভাবে? রিকশা চালিয়েই তো খাওয়া চলে। চার দিন ধরে দেশে কারফিউ চলছে। পেট তো আর কারফিউ বুঝে না। কাজকাম বন্ধ রাখলে পরিবারের খরচ কীভাবে চালাবো? সংসারে চাল-ডাল, তরকারি কিনতে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা লাগে। রিকশা কিনতে এনজিও থেকে এক লাখ টাকা লোন নিয়েছি। কারফিউ থাকলেও সপ্তাহের শেষে কিস্তি মাফ নেই।
দেশে এখন কারফিউ, এর আগে বেশ কয়েকদিন গোলযোগ ছিল। চলাফেরা কম, আয়-রোজগারও কম। ঘরে যা মিষ্টি আর চাল ছিল, তা দিয়ে কয়েকদিন তিন বেলা খেয়েছি। এখন সব শেষ। তাই রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, বাজার খরচের টাকাও পকেটে নেই। কারফিউ ভাঙে বিয়ানের বেলা, শেষ বিকেলে যদি ৫০০ টাকা না হয়, তাহলে খামু কী? আমার মতো গরিবের সংসারে এখন ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই কারফিউ চলছে।"
হুট করেই থামিয়ে দিলো সবার জীবন
করোনার সময় ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘লকডাউন’, ‘নিউ নরমাল’-এর মতো নতুন শব্দগুলো নাগরিক জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। এবার হুট করেই ‘শাটডাউন’ আর ‘কারফিউ’ থামিয়ে দিলো সবার জীবন। রাস্তাঘাটে বের হওয়ার উপায় নেই, ঘরে ইন্টারনেট নেই; মনে হচ্ছিল আবার কয়েকদিনের জন্য ঘরে আটকে পড়লাম। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়েই কেটেছে কারফিউ ও শাটডাউনের দিনগুলো। রাস্তার গোলাগুলির শব্দ, চিৎকার... ভয়ই হতো। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম শত শত পুলিশ, বিজিবি। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ‘যুদ্ধপ্রস্তুতি’ নিয়ে বের হয়েছে মনে হচ্ছিল। সাদা ট্যাংকের ওপর মেশিনগান তাক করে আছে। সামনে থেকে দেখলে ভয় পেতেই হয়। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার টহল, তা দেখেই তো ছাদ থেকে নেমে আসতাম।
কারফিউয়ের কারণে ঠিকঠাক বাজারও করা সম্ভব হয়নি। সোমবার মনে হচ্ছিল না খেয়েই থাকতে হবে। শিথিল সময়ে বাজারে গিয়ে দেখি জিনিসপত্রের দামে আগুন। এমনকি ফোনে রিচার্জ করতে গিয়েও দিতে হয়েছে বাড়তি ৫ টাকা। ২০২৪ সালে এসেও এমন দিন দেখতে হবে ভাবিনি।
— ফাবিহা আলম, শিক্ষার্থী, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
শেষমেষ কক্সবাজারে আটকা পড়লাম
আমি ঢাকায় ছোটখাট একটা চাকরি করি। দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে আমার ছোট সংসার। অনেক সময় ছুটির অভাবে, কখনো টাকাপয়সার সংকটে পরিবার নিয়ে কোথাও যাওয়া হয় না। এবার আশুরার ছুটি মিলিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। মঙ্গলবার রাতে যখন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম, তখনও ঢাকায় গণ্ডগোল ছিল। তবে এভাবে বাড়বে তা মনে হয়নি।
কক্সবাজার থেকে আমাদের ফেরার কথা ছিল শনিবারেই, সেভাবেই টাকাপয়সা নিয়ে গেলাম। কিন্তু কক্সবাজার যাওয়ার পরই টিভি-ফেসবুকে দেখলাম ঝামেলা বাড়ছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ধারণা ছিল কোনো না কোনোভাবে ফিরে আসব। কিন্তু শেষমেষ আটকা পড়লাম। সারাদেশে কারফিউ, কোনো গাড়ি চলছে না। টাকাপয়সা শেষ, বউ-বাচ্চার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা। বিকাশে টাকা তুলতে গিয়ে হয়রানি, হোটেলে ডাল-ভাতেও জনপ্রতি ২০০ টাকা বিল।
শেষ দুদিন কম কম খাওয়া শুরু করলাম। বিশেষ ব্যবস্থায় মঙ্গলবার ঢাকায় এসে পৌঁছালাম, তখন মনটা একটু শান্ত হলো। কিন্তু আসার সময় যে পরিস্থিতি দেখলাম, মনে হলো-এই বাংলাদেশ একেবারেই নতুন। চারদিকে থমথমে পরিস্থিতি। যুদ্ধের সময়ও হয়তো এমনই হয়।
— আশরাফুল হোসেন, পর্যটক
মা, কথা তো বোঝা যাচ্ছে না...'
সারাদিন খাটুনি খেটে রাতে প্রিয়জনের সঙ্গে সুখ-দুঃখের আলাপই তো প্রবাসীদের শান্তি। গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। মনে হচ্ছে প্রবাসীদের থেকে পুরো বাংলাদেশকেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় পুরো এক সপ্তাহ মায়ের মুখখানি দেখি না। শহরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এসেছে, কিন্তু আমাদের গ্রামে সে ব্যবস্থা নেই। নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে ফোনকলেও সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিন মাকে কল করে এটুকুই বলতে হয়, 'মা, কথা তো বোঝা যাচ্ছে না...।'
ওপাশ থেকে হয়তো মা-ও বলছেন, 'হ্যালো বাবু, কথা তো শোনা যায় না...।' মা, তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। সারাদিন বাড়িতে কী কী ঘটে, তা জানার জন্য প্রতিদিনই তুমি অপেক্ষায় থাকো। আমিও মনভরে তোমার সেই কথাগুলো শুনি। তিন বছরে একটুও ব্যত্যয় ঘটেনি। আজ প্রবাসে বসে অশ্রুসিক্ত নয়নে সবই মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, এই কয়েকটা দিনের জন্য আমার মাকে আমার থেকে আলাদা করে রেখেছে কেউ। দূর প্রবাসে পাহাড়ের পাদদেশে অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ের জন্য হাহাকার করছি। প্রিয় মাতৃভূমির জন্য হাহাকার করছি। আমার একটাই প্রশ্ন, লাখ লাখ প্রবাসীর এই কান্না কি সরকার শুনতে পায় না?
— সাব্বির আহমেদ, ইতালি প্রবাসী
তথ্য ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে নেওয়া
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"