সম্প্রতি প্রকৃতির আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এবার যেমন তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা আগে কখনো দেখা যায়...
সম্প্রতি প্রকৃতির আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এবার যেমন তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ও অসহনীয় গরম আমাদের জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা প্রদান করে, যা আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে নিশ্চিত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে তাপপ্রবাহ আরও তীব্র হয়ে বাংলাদেশ ও আশেপাশের দেশে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এই সমস্যা সমাধানে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (Nature-Based Solutions: NBS) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। টেকসই উন্নয়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণের সামর্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে না। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান হলো এমন পদ্ধতি, যা পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের শক্তিকে কাজে লাগায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান আমাদের নতুন পথ দেখাতে পারে। এটি একটি কৌশলগত সমাধান, যা পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সমাধানে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের শক্তিকে কাজে লাগায়।
একটু ভাবলেই দেখা যাবে, বন উজাড় হওয়া স্থানগুলোতে পুনরায় বনায়ন হচ্ছে। এসব জায়গা স্থানীয় জাতের গাছপালায় ভরে উঠছে, যা জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয়রোধ, এবং বাতাস ও পানির গুণগত মান উন্নত করতে সহায়ক। রাস্তার দুপাশে সারি সারি স্থানীয় গাছ শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করছে না, তাপপ্রবাহ রোধেও প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করছে। গাছের পাতা, শাখা-প্রশাখা এবং মাটি রোদের তাপ শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখছে। সবুজ কৃষিজমিতে শিমুল-পলাশের মতো দেশীয় জাতের গাছ ফসলের মাঠে ছায়া এবং বায়ু সুরক্ষা প্রদান করে, যা তাপের প্রভাব কমিয়ে ফলন বাড়াচ্ছে।
আরেকটু ভাবলে দেখা যাবে, সারা দেশের শহরগুলো প্রাণবন্ত সবুজ নগরে রূপান্তরিত হয়েছে। গাছপালা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং নির্মল ও সজীব বায়ু সরবরাহ করতে সহায়তা করছে। এই মনোরম দৃশ্যগুলো কল্পনা নয়, বরং প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে টেকসই করার কিছু উদাহরণ। একটু মনোযোগ দিলেই এই কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তর করা সম্ভব। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (NBS) পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি কার্যকর পদ্ধতি, যা বহুমুখী সুবিধা প্রদান করে। প্রচলিত অবকাঠামোগত সমাধানের তুলনায় এনবিএস অনেক সাশ্রয়ী, কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় এবং অতিরিক্ত পরিবেশগত সুবিধা প্রদান করে।
যদি আমরা প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান (NBS) সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কতটা কার্যকর হতে পারে তা স্পষ্ট হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারে। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ঝরনা ও ঝিরিকে প্রধান পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও শুষ্ক মৌসুমে এসব ঝিরি ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে, যা পানীয়জলের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব তীব্রতর হচ্ছে। দূষিত পানি পান করার ফলে পানিবাহিত রোগও ছড়াচ্ছে। এ অবস্থায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ঝরনার ওপরের বনভূমি ঝরনার পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঝরনার চারপাশে স্থানীয় গাছ লাগানো পানি পরিশোধনে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, বনভূমি বৃষ্টির পানি ধরে রাখে এবং ধীরে ধীরে ঝরনায় প্রবাহিত করে, যা শুষ্ক মৌসুমেও পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। গাছপালা মাটি ধরে রাখে, ভূমি ক্ষয় রোধ করে এবং ঝরনায় জমা হওয়া পলির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।
আজকের বিশ্বে, যেখানে আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত অবক্ষয় এবং টেকসই উন্নয়নের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান এক নতুন আশার আলো হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছে। তবে, এসব সমাধানের গ্রহণযোগ্যতা ও কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য একটি সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট নীতিকাঠামো অপরিহার্য। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে কার্যকর প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের বিস্তৃত ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে। এজন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয়, বরং আমাদের টিকে থাকার জন্য একটি অপরিহার্য প্রয়োজন।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"