বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল খেলোয়াররা ছোটখাটো একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই বিপ্লবে পাহাড়ি আদিবাসী, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কিছু নিম্নবৃ...
বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল খেলোয়াররা ছোটখাটো একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই বিপ্লবে পাহাড়ি আদিবাসী, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের কিছু নিম্নবৃত্ত পরিবারের মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছেন। তারা বয়সভিত্তিক একাধিক সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পাশাপাশি সাফের মূল পর্বের শিরোপাও জিতেছেন। এই মেয়েরা দারিদ্র্য, সামাজিক বাধা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের বাধা পেরিয়ে এসে শীর্ষ পর্যায়ে মন জয় করা ফুটবল খেলেছেন। তবে, প্রান্ত থেকে উঠে আসা এই মেয়েদের অনেকে অল্প দিনেই হারিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন।
রাজিয়ার মৃত্যু:
সম্প্রতি বয়সভিত্তিক সাফ জয়ী নারী ফুটবলার রাজিয়া খাতুনের মৃত্যু হয়েছে। যিনি সন্তান জন্ম দিতে দিয়ে মারা গিয়েছেন। তিনি সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এক ফুটবলার ছিলেন এবং জাতীয় দলের ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ফুটবল ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন, যদিও ফেরার জন্য প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। তবে, ফেরা হয়নি এবং তার মতো, গত বছর হুট করে অবসর নেন জাতীয় দলের হয়ে সাফ জয়ী ২২ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান। সাফে ৪ গোল করেছিলেন তিনি এবং একই বছরে ক্যাম্প থেকে বাদ পড়ে ২০ বছরেই ফুটবল যাত্রার সমাপ্তি টানেন সাফজয়ী আনুচিং মগিনী।
ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন চীনে ফুটবল খেলতে যাওয়া তিনি দেশের ফুটবল মাঠে বরাবরই মতোউপস্থিত নেই। এই অবস্থায় তাদের সাথে মিলে রুপা আক্তার, মিসরাত জাহান মৌসুমী, সাজিদা খাতুনও ফুটবল মাঠে নেই। এই মেয়েদের দুরাবস্থার কারণ হল ইনজুরি। প্রযুক্তিবিদদের সঠিক চিকিৎসা ও যথাযথ সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে তারা ফুটবল খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। অদূর অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই মেয়েদের মধ্যে ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখা, নিজের আর্থিক উন্নতি এবং সামাজিক মর্যাদা অর্জনের ইচ্ছা রয়েছে আর মনে হচ্ছে আছে । তবে, দেশের নারী ফুটবলের প্রস্তুতি ও ক্যাঠামো বৈশ্বিক মানের মাঝে সামঞ্জস্যতার অভাবে তারা পরাজিত হয়েছেন।
এখন এটা প্রস্তুতির সময়, যমুনা নদীর কোলসিন্দুর এলাকার মেয়েরা ফুটবল খেলছেন, তবে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর সাবেক বিজয়ী টিম, বাঁশজানি জেলার 'চ্যাম্পিয়ন' মেয়েরা অনুভব করেছেন অন্ধকারের দিকের পথ তাদের মনোনিবেশ হচ্ছে। ২০১৮ সালে তারা তাদের অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন হতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং তারা তাদের ক্ষমতার উপরে গর্ব অনুভব করতেন। তারপরেই, তারা হ্যাটট্রিক কন্যাখ্যাত স্বরলিকা পারভীনের নেতৃত্বে আরো এগিয়ে চলে গিয়েছিলেন। স্বরলিকা এবং তার দল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছিলেন। তবে, এই সময়ে মহামারির পরিস্থিতিতে তারা অনেকটা আশাবাদ হারিয়ে গেছেন। অভাবে আর অনিশ্চয়তায় প্রভাবিত হওয়ায় স্বরলিকাসহ সাতজন খেলোয়াড় বিবাহ বা অন্যান্য সমস্যার মুখোমুখি হয়ে গেছেন। এখন এই সাতটি মেয়ে সংসারের জোয়ালে বাঁধা বসে আছেন। কি আছে নওগাঁর ঘোড়সওয়ার মেয়ে তাসমিনা? তার সম্পর্কে কি খবর?
আরেক কলসুন্দর নামের একজন সাবিনা তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগেছেন এবং তার চিকিৎসা না করেই তার মৃত্যু হয়েছে। আমরা শুরু করলাম, তবে শেষ করা হয়নি। এক অস্থির অবস্থায় স্বরলিকার কানে এই বক্তব্যটি একটি শক্ত প্রভাব ছেড়ে দিয়েছে, "আমরা গ্রামে বড় হচ্ছি। খেলাধুলার সুযোগ কমে আসছে। যদি আমরা কোনো বিশেষ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারি তাহলে আমরা আরও ভালো করতে পারব।"
২০১৭ সালের টুর্নামেন্ট সেরা স্বরলীকা পারভিন। ২০২১ সালে বাল্যবিয়েতে হারিয়ে যায় ফুটবল থেকে। ছবি: সংগৃহিত |
নারী ফুটবলারদের উঠে আসার গল্প:
বাংলাদেশের নারী ফুটবল খেলোয়াড়দের উন্নয়নের চিন্তায় অবদান রাখতে বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ভালো অবস্থান পেয়েছে। এ টুর্নামেন্টে তারা উত্তীর্ণতা প্রদর্শন করে বাফুফের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছেন, যেখানে তাদের অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ বয়সের প্রতিযোগিতা সাজানো হয়। তাদের জন্য ক্যাম্পে আবাসন-খাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে এবং পড়াশুনায় সাহায্যও প্রদান করা হয়েছে। অনূর্ধ্ব-১৯ বয়সের খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে এবং তাদের জন্য যে বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়, সেটা বাফুফের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হবে।
নারী ফুটবলারদের বেতন-ভাতা:
জাতীয় দলের ৩১ জন ফুটবলারের সাথে তুলনা করে বাফুফে বেতন থেকে প্রদান করা হয়। তবে, এটা শুধুমাত্র সম্মানের মাত্রা। প্রতি মাসের জন্য অনুমিত বেতন প্রদানের বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী - ১৫ জন ফুটবলারকে ৫০ হাজার টাকা, ১০ জনকে ৩০ হাজার টাকা এবং বাকিদেরকে ১৮-২০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। বাকি ফুটবলারদের লিগের দিকে আশা করা হয়।
মেয়েদের ফুটবল লিগ কেমন:
বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল লিগের ধারাবাহিকতা ছেলেদের ফুটবল বা বৈশ্বিক ফুটবলের মতো নয়। বৈশ্বিক ফুটবল লিগ প্রায়ই সারা বছর চলে। ছেলেদের ফুটবল লিগও ওই প্রণালী অনুসরণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে মহিলা ফুটবল লিগ সারা বছরের জন্য নয়, তা মাত্র দেড় মাসের জন্য। এই সময়কালে নারী ফুটবলারদের তেমন রোজগার সৃষ্টি হয় না। দেড় মাসের ফুটবল লিগের জন্য পূর্ণ বছরের মতো ট্রেনিং করা, জিম করা, ফিটনেস নিয়ে কাজ করার সুযোগ-সুবিধাও তাদের পাওয়া যায় না।
নারী ফুটবলাররা খেলাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন না:
এখানে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল লিগ হয় বৈশ্বিক ফুটবল ক্লাব ভিত্তিক। ফুটবলারদের ক্লাবে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। তাদের মধ্যে ক্লাব থেকেই বেতন এবং ভাতা প্রাপ্ত হয়। লিগ সারা বছর চলে এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলের মঞ্চে তারা প্রতিদিন বসে থাকেন। তাদের ম্যাচ ফি ফেডারেশন থেকে দেওয়া হয় । তবে, বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল লিগের প্রেক্ষাপট প্রায় ভিন্ন। এখানে মেয়েদের ফুটবল লিগ এখনো পুরানো কাঠামো অনুসরণ করে চলে । ২০১১ সালে মেয়েদের ফুটবল লিগ আরম্ভ হয়। পরবর্তী বছরে এটি আর দাঁড়াতে পারেনি । ২০১৩ সালে তা পুনরায় আরম্ভ হয়। সাত বছর পর ২০১৯ সালে মেয়েদের লিগ পুনরায় শুরু হয়। যদিও আগামী দুই বছরে তা চালিত হয়েছিল, কিন্তু ২০২৩ সালে এটি আবারও বন্ধ হয়ে গেয়েছিল। ওই সময়ে অনেকে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই বছরেও ক্লাবগুলির অনাগ্রহে মেয়েদের লিগ অনিশ্চিত ছিল।
আর্থিক নিশ্চয়তাই কি ফুটবল ছাড়ার মূল কারণ:
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের নেতা নিগার সুলতানা বলেছেন, ‘ক্যারিয়ারে সাফল্য প্রাপ্তি জিনিসগুলো ইতিবাচক।’ এই সাফল্যের পেছনে অর্থনৈতিক স্থিতি অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেদের তুলনায় অনেক কম বেতন পান নারী ক্রিকেটাররা। তবে, ফুটবল ফেডারেশন থেকে মেয়েরা খুব কম বেতন পান। জাতীয় দলে যোগদান না হলে ওই বেতন পেতে সম্ভব হয় না। দেড় মাসের লিগ ফুটবল পেশাও বলা হয় না। এই কারণে ফুটবল ছাড়া অনেকের জীবনযাপনে অবস্থান পাওয়া সহজ হয় না।
মেয়েদের ফুটবলে ধরে রাখতে করণীয়:
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একত্রিত হতে পারে যেন আরো বেশি সংখ্যক নারী ফুটবলারদের চুক্তিবদ্ধ করতে পারে । যদিও বাফুফে প্রতিষ্ঠানিক চেষ্টা করছে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা উন্নত করতে, সেজন্য সরকারী সহায়তা প্রয়োজন। ফুটবল লিগ ভিত্তিক বাংলাদেশে মহিলা ফুটবল লীগ প্রতিষ্ঠা করে সারা বছরের লিগ হিসাবে চলার জন্য এবং বৈশ্বিক মান অনুসারে তাদের উন্নতির জন্য সরকারের পাশাপাশি ফুটবল ক্লাব এবং সংগঠনগুলি অগ্রগতি করতে পারে।
সাফ কাপের চ্যাম্পিয়নরা সবাই গ্রামের গরিব পরিবারের মেয়ে। শহরের মধ্যবিত্তদের চেয়ে তারা অনেক সাহসী এবং প্রগতিশীল। গ্রামীণ সংরক্ষণশীলতা মিথ্যা এবং এই মেয়েদের পরিবার এবং শিক্ষকদের এবং সমাজের মিথ্যা ভেঙ্গে দেয়েছে। তবে, সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি যা করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলি কি ঠিকমতো করা হয়েছে তা প্রশ্ন উঠে এসেছে। রাজিয়া খাতুন এবং সাবিনা সহ মৃত্যু। তাদের স্মৃতি আমরা চিরকাল কি মনে রাখব।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"