আইপিএলে গতকাল চেন্নাই সুপার কিংসে মোস্তাফিজুর রহমান নিজের অভিষেক ম্যাচেই ৪ উইকেট নিলেন। আর স্পষ্টতই বললে বলতে হয়, ১০ বলেই ৪ উইকেট! সেটাও য...
আইপিএলে গতকাল চেন্নাই সুপার কিংসে মোস্তাফিজুর রহমান নিজের অভিষেক ম্যাচেই ৪ উইকেট নিলেন। আর স্পষ্টতই বললে বলতে হয়, ১০ বলেই ৪ উইকেট! সেটাও যেনতেন কোনো ব্যাটসম্যান নন, বিপক্ষের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ব্যাটিং লাইনআপে শুরুর তিনজন বিরাট কোহলি, ফাফ ডু প্লেসি, এবং রজত পাতিদার এবং পাঁচ নম্বরে ক্যামেরুন গ্রিনের নাম। কম সার্চে বেটা।
আসরের শুরুতে মোস্তাফিজের অবিশ্বাস্য বোলিং রাতে ঝলমলে আলো ছুঁড়ে দিয়েছিল। এটি দেখে অনেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী, এমনকি তাঁর অনুগামী এবং সমর্থকরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন, আরো কখন মোস্তাফিজ এত ভালো বোলিং দেখাবেন? কিছু মানুষ বলেছিলেন, 'মাথায় আঘাত পাওয়ার পরে মোস্তাফিজ আবার ভালো বোলিং করার স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়েছেন।
সর্বশেষ বিপিএলে চট্টগ্রামে অনুশীলনের সময় মোস্তাফিজকে বলের আঘাতে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল, যেখানে তাকে মাথায় ৫ সেলাই দিতে হয়েছে । সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এটা ব্যাপকভাবে চর্চা করেছেন। এটি না মাত্র বিপিএলে, আগে এই চট্টগ্রামেই তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি ওয়ানডে ম্যাচে বল করতে গিয়ে পায়ের মাংসপেশিতে টান (ক্র্যাম্প) লাগার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ব্যথায় কাতরাতে থাকা বাঁহাতি পেসারকে সেই দিন স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এই ঘটনার পরিণামে তাঁর বোলিং কোটার শেষ ওভার হয়েছিল, তবে বাংলাদেশ দলের কোনো বড় ক্ষতি হয়নি, কিন্তু চেন্নাই সুপার কিংসের কেউ যদি এই অবস্থা দেখে থাকতেন, তারা নিশ্চিতভাবে চিন্তিত হয়ে পড়তেন। এই ঘটনাটি যে ঘটেছিল আইপিএল শুরুর মাত্র ৩ দিন আগে।
তবে সব চিন্তা মুছে দিয়ে পরের দিনেই ভারতে মোস্তাফিজ অবিশ্বাস্য বোলিং করেন। চেন্নাই দলে যোগ দেওয়ার ২ দিনের মধ্যে নতুন পরিবেশে সম্মিলিত হন। আর আজ তার নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে প্রথমবার খেলতে নিচ্ছেন, এবং সেখানে তার সাক্ষাৎকার একটি পুরানো জাদু নিয়ে এনেছে। তার বীরত্ব সেই মধুর স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে, যেন সে ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে একলা জিতে ফেলেছিলেন অথবা ২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের জার্সিতে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের দিশাহারা করেছিলেন। এখন মোস্তাফিজ সেই জগৎে প্রবেশ করেছেন!
আগের রসিকতা বিষয়টি পাশ কাটিয়ে, এখন আসুন বাস্তবতায়। এই মাসে চট্টগ্রামের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের আগে সিলেটে বাংলাদেশের তিনটি ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজও খেলা হয়েছিল। প্রিভিয়াস দুই টি-টোয়েন্টিতে বোলিংও খারাপ হলেও, মোস্তাফিজকে সিরিজের নির্ধারিত ম্যাচে একাদশে রাখা হয়েছিল। এই সম্পর্কে কিছু ক্রিকেট পর্যালোচক টিম ম্যানেজমেন্টের ক্রিকেট বুদ্ধিমান্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন। সিরিজের শেষে, মোস্তাফিজ রেট ১০.৯২ একনমি নিতে পেরেছেন, ১২ ওভারে কেবল ১৩১ রান দিয়ে; একেবারেই মাত্র ২টি উইকেট নিয়ে।
সেই মোস্তাফিজ আইপিএলে খেলতে গিয়ে অন্ধকার সরিয়ে আলোর দেখা আনলেন! এর কারণ হলো চেন্নাইয়ের মাঠ এমএ চিদাম্বরাম স্টেডিয়াম। চিদাম্বরামের পিচ শুধু মোস্তাফিজকে অভিনব অনুভূতি দেয়, এটির সাথে তুলনা করা যায় মিরপুর শেরেবাংলার সাথে। এখানে মোস্তাফিজকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ প্রয়োজন পরে না। শুধুমাত্র নিজের কাজগুলি ঠিক করে সামগ্রিক সুবিধা অর্জন করে গেলেই যথার্থ হয়।
চেন্নাইর ২২ গজে ‘দ্য ফিজ’ কার্যকর করেছেন রাতে। পিচের সহায়তায় বৈচিত্র্যময় বোলিং প্রদর্শন করেছেন; কখনো স্লোয়ার, কখনো সেই দুর্বোধ্য কাটার। পূর্বে আরও চারটি ফ্র্যাঞ্চাইজি (সানরাইজার্স হাইদরাবাদ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, রাজস্থান রয়্যালস, দিল্লি ক্যাপিটালস) এখনও খেলেছিল, তবে চেন্নাই সুপার কিংসকে অবাধ মোস্তাফিজের জন্য নতুন ঘর হিসাবে মনে হয়েছে, চিদাম্বরামের সহায়ক পিচের কারণে। এই সঙ্গে চেন্নাইর নতুন অধীনায়ক রুতুরাজ গায়কোয়াডের অদ্ভুত নেতৃত্ব, ফিল্ড সেটিং এবং সতীর্থ রাচিন রবীন্দ্র এবং অজিঙ্কা রাহানের অসাধারণ ফিল্ডিং ছিল।
চেন্নাইতে কাল মোস্তাফিজের কৌশল দেখে ব্যবহার করা হয়েছে এমন ধারণার অধিকার গঠন হচ্ছে। এ কারণে একটি নতুন প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশের অধিনায়ক বা টিম ব্যবস্থাপনা কি সঠিকভাবে মোস্তাফিজকে ব্যবহার করতে পারবেন না? বাংলাদেশ দলের মোস্তাফিজের ব্যবহারের সঠিকতা এখানে বিবেচনা করা উচিত নয়। তবে, চেন্নাইতে মোস্তাফিজের কার্যক্ষমতা প্রকাশ্যে হলেও, এটি অনেকের জন্য অনুসরণযোগ্য হতে পারে।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু, কারণ অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি এক্ষেত্রে নেতৃত্বে উত্তোলন করেছিলেন। কোহলি একটি প্রান্তে দর্শকদের আকর্ষণে নিয়ে রেখে, শট খেলতে থাকেন মাঠের চারপাশে ডু প্লেসি। ৪ ওভারে উইকেট হারাই ব্যাটসম্যানরা ৩৭ রান প্রাপ্তি করেছিলেন। ডু প্লেসি একাই মারা গেছে ৭ বাউন্ডারি রান। ২০২২ সালে বেঙ্গালুরুতে যোগ দেওয়ার আগে, এই অধিনায়ক দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক খেলোয়াড় নৌকায় নিজেকে প্রদর্শন করেছিলেন।
বেঙ্গালুরুর খেলোয়াড়দের মধ্যে চিদাম্বরাম কন্ডিশন সম্পর্কে জানা শুধু চেন্নাইয়েরই সন্তান দিনেশ কার্তিক। তার এই জানাশোনা থেকেই হয়তো পিচের আবশ্যকতা ও মহারূক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে ডু প্লেসির চেয়ে আরও ভালো ধারণা থাকতো। যে সময় পিচে পাওয়ার প্লের সুযোগ আছে, তখন তিনি সম্ভবত মেরে খেলার ইচ্ছা করেছিলেন। তাঁকে এই ধারণা নিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন নতুন অধিনায়ক রুতুরাজ। পঞ্চম ওভারে বোলিংয়ে আনেন মোস্তাফিজকে।
মোস্তাফিজকে তাঁর দ্বিতীয় বলে সীমানাছাড়া করে দিয়েছেন ডু প্লেসি। তবে, রুতুরাজ এতে চিন্তিত হয়নি, বরং তার নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত প্রশংসা করেছেন। বাউন্ডারি ঠেকাতে রুতুরাজ রাচিন রবীন্দ্রকে পাঠান ডিপ কাভারে ফিল্ডিং করতে।
মোস্তাফিজ ও ডু প্লেসি আইপিএলে প্রতিপক্ষ হলে কী হবে, বিপিএলে একবার কিন্তু সতীর্থও ছিলেন। ২০২২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হিসেবে বিপিএল খেলে গেছেন ডু প্লেসি। কুমিল্লার সেই দলে মোস্তাফিজও ছিলেন। দলের নেট অনুশীলনে ডু প্লেসিকে করা মোস্তাফিজের বোলিংয়ের ছবি খুঁজলে নিশ্চয় এখনো পাওয়া যাবে। ডু প্লেসিকে কিছুদিনের জন্য সতীর্থ হিসাবে পেয়ে মোস্তাফিজ হয়তো তাঁর দুর্বলতার জায়গাগুলোও ‘চিহ্নিত’ করে রেখেছিলেন। না তবে কাল ডু প্লেসির কাছে বাউন্ডারি খাওয়ার পরের বলেই জায়গামতো ফিল্ডিং সেট করার প্রয়োজনে তার লেগ কাটার দিতে যাবেন কেন! বাঁহাতি পেসারের সেই লেগ কাটারকে আবারও সীমানাছাড়া করতে গিয়ে একটু আগেই ডিপ কাভারে দাঁড়ানো রবীন্দ্র হাতে ধরা পড়েন। ওভারের শেষ বলে মোস্তাফিজ পান আরেকটি উইকেট। অফ স্টাম্পের একটি বল পরিষ্কারভাবে মারতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ধোনিকে ক্যাচ দিলেন রজত পাতিদার।
পাওয়ার প্লেতে ওই এক ওভারই করেছেন মোস্তাফিজ। তাঁকে আবার বোলিংয়ে ফেরানো হয়েছে ১২তম ওভারে, উইকেটের প্রয়োজনীয়তার কারণে। মাঝে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে (০) দীপক চাহার ফেরালেও চতুর্থ উইকেটে কোহলি-গ্রিনের জুটিটা বেশ জমে উঠছিল। এ জুটি ভেঙে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ হয়েছিল মোস্তাফিজের উপর। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ‘দ্য ফিজ’ চেন্নাইকে শুধু সাফল্য এনে দেননি, প্রত্যাশার চেয়ে হয়তো বেশি দিয়েছেন। ওভারের দ্বিতীয় বলটি তিনি করেছেন ব্যাক অব লেংথে, যাতে না ছিল কোনো গতি। কোহলি সেটাকেই ছক্কা মারার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাউন্ডারি লাইনের কাছে রাহানে-রবীন্দ্রের অসাধারণ বোঝাপড়া কারণে ক্যাচ দিতে হয়েছিল মোস্তাফিজকে। এক বল পরেই আরেক সেট ব্যাটসম্যান গ্রিনকেও ফেরানো হয়েছে মোস্তাফিজের। তার লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচে করানো বলটি তিন স্টাম্প ছেড়ে দিয়ে কাটতে চেয়েছিল গ্রিন। কিন্তু এটি অপস্থিতি হয়ে আসে অ্যাঙ্গেল হয়ে এসে জিং বেলের বাতি জ্বালিয়ে দেয়, এবং লাল বাতিতে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের মাথায় ধরা পড়ে।
প্রথম ১০ বলে মাত্র ৬ রান দিয়ে ৪ উইকেট। ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকেটবাজের সরাসরি ধারাবিবরণীতে সেটাকে দেখানো হয়েছে এভাবে—‘৪-৬! এটা কোনো ব্যাডমিন্টন ম্যাচের স্কোর নয়।’ এ নিয়ে ৭ মৌসুম আইপিএল খেলতে নামা মোস্তাফিজ কালই উপহার দিয়েছেন এ টুর্নামে তাঁর সেরা বোলিং। শেষের ২ ওভারে ২৩ রান দিলেও বোলিং ফিগারটা বেশ ভদ্রস্থ: ৪ ওভার-১২ ডট-২৯ রান-৪ উইকেট; যা আইপিএলে কোনো বাংলাদেশি বোলারেরও সেরা। আগের সেরা বোলিংও তাঁরই ছিল। ২০১৬ সালে নিজের অভিষেক মৌসুমে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে ১৬ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট।
কাল আরেকটি মাইলফলক ছুঁয়েছেন মোস্তাফিজ। সাকিব আল হাসানের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে আইপিএলে ৫০ উইকেট নিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে আইপিএল খেলা সাকিব নিয়েছেন ৬৩ উইকেট, মোস্তাফিজের উইকেট ৫১টি। ৫০তম উইকেটের স্মৃতি অনেক দিন মনে রাখার কথা মোস্তাফিজের। ‘শিকার’টা যে ছিলেন বিরাট কোহলি!
মোস্তাফিজের তোপে ৭৮ রানে ৫ উইকেট হারানোর পরও বেঙ্গালুরু যে ১৭৩ রানের বড় সংগ্রহ করতে পেরেছিল, সেটা অনুজ রাওয়াত আর দিনেশ কার্তিকের ৯৫ রানের জুটির কারণেই। আগেই বলা হয়েছে, কার্তিকের জন্ম এই চেন্নাইয়েই। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে কার্তিকই এসেছিলেন বেঙ্গালুরুর প্রতিনিধি হয়ে।
সেখানে মোস্তাফিজকে প্রশংসায় ভাসাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এটা খুব ভালো পিচ ছিল। আমরা মনে মনে চিপকের যে মন্থর পিচের ছবি এঁকে থাকি, এটা তেমনটা ছিল না। বল স্কিড করেছে, ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো ছিল। সে (মোস্তাফিজ) সত্যিই দারুণ বোলিং করেছে। সে প্রতি ঘণ্টায় ১৩৮-১৩৯ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারে আবার চাইলেই স্লোয়ার মারতে পারে, যা ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করে এবং খেলা কঠিন হয়ে ওঠে। সে ১২০-১২৫ গতিতে কিছু বল করেছে, যেগুলো সামলানো সত্যিই কঠিন ছিল। এটাই ওর বিশেষত্ব। ও একজন বিশ্বমানের বোলার।’
এমন বোলিংয়ের পর মোস্তাফিজের হাতে ম্যাচসেরার পুরস্কার ওঠাটা অনুমেয়ই ছিল। পুরস্কারটা তিনি পেয়েছেনও। মোস্তাফিজের জন্য কালকের রাতটা যে আক্ষরিক অর্থেই ছিল বল হাতে অনেক কিছুর জবাব দেওয়ার রাত।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"