তরুণ মন কত কী যে স্বপ্ন দেখতে পারে! তা কেবল যে তরুণ সেই জানে। একমাত্র তারুণ্যের এগিয়ে চলার সামনে কেউ বাধা হতে পারেনা। কেউ সেই স্বপ্নের সাথ...
তরুণ মন কত কী যে স্বপ্ন দেখতে পারে! তা কেবল যে তরুণ সেই জানে। একমাত্র তারুণ্যের এগিয়ে চলার সামনে কেউ বাধা হতে পারেনা। কেউ সেই স্বপ্নের সাথে মন ভরে আগামীর পথে প্রবর্তন বা পথচলা শুরু করে। এই পথ চলার সময়ে স্বপ্নের ধারণাগুলি তাদের লক্ষ্যে নিয়ে যায়। তারুণ্য মানে এক কিংবদন্তির পূর্বাভাস। তেমনই এক স্বপ্নবান তরুণ পেয়ে ছিলেন বাংলার ঢালিউড, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নায়ক হওয়ার। আর সে স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে। তিনি বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বাংলার মানুষের মাঝে একটি জনগণের গণপ্রিয় আর জনপ্রিয় নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। তার পূর্ণ নাম এস এম আসলাম তালুকদার। তাঁর সংগে যারা কিছুটা যোগাযোগ রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রে, তারা এই ব্যক্তিকে সাধারণত মান্না নামে চিহ্নিত করেন। মৃত্যুর ১৬ বছর পর হলেও মানুষের মনে এখনও তার স্থান পরিবর্তন হয়নি। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলি মানুষের মনে সত্যি জীবন্ত করে রেখেছে।
সত্যিই বলতে হলো, এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে যারা মৃত্যুর পরেও সবার হৃদয়ে অধিক ভালোবাসা পেয়ে থাকে। আর তাদের কখনোই মৃত্যু হয় না। তারা জীবনে চিরকাল অমর রয়েছে মানুষের মনে। বিশেষত, তারকাদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রমান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একজন মান্না সেই জীবন্ত উদাহরণ। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্মগ্রহণ করেন এস এম আসলাম তালুকদার মান্না, সে ছোটবেলা থেকেই সিনেমার জন্য অত্যাধিক ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। কলেজে পড়ার সময়ে সে অনেক সিনেমা দেখতেন। যখন নায়ক রাজ্জাকের সিনেমা দেখতেন তখন তার মনের ভাব জন্মেছিলো, সেখান থেকেই নায়ক হতে ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। ছোটবেলায় অনেকের চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা থাকে, কিন্তু মান্নার তেমন কোনো ইচ্ছা ছিল না। একদিন তার কাছে 'নতুন মুখের সন্ধানে' এর বিজ্ঞাপনের দৃশ্য চোখে পড়ে, তারপর তিনি টিভি ও পত্রিকায় দেখে তার বন্ধুদের সাথে আলাপ করে তাদের সঙ্গে ইন্টারভিউ দেন। আর সেখান থেকেই সুযোগ পেয়ে গেল মান্না।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করার পর ১৯৮৪ সালে 'নতুন মুখের সন্ধানে' প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন এস এম আসলাম তালুকদার। টাঙ্গাইলের সেই তরুণ যে সময়ে সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে আরো উন্নত হতে চাচ্ছিলেন কিন্তু জানতেন না যে তিনি একদিন ঢাকার চলচ্চিত্র জগতের এতো জনপ্রিয় নায়ক হবেন। ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে একজন নির্ভরযোগ্য নায়ক হওয়ার জন্য তাকে প্রচুর প্রস্তুতি করতে হয়েছে। 'নতুন মুখের সন্ধানে' প্রোগ্রামের অনুমতি পাওয়ার পরেই আসলামের কাছে নায়ক মান্না হওয়ার সুযোগ হয়নি। এর জন্য তাকে অনেক ত্যাগ এবং কঠিন কাজ করতে হয়েছে। এফডিসির অফিসে প্রতিদিনের মত ঘোরাঘুরি এবং পরিচালকদের কাছে ধরণা দিতে হয়েছে। যে রাজ্জাককে দেখে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের স্বপ্ন দেখতেন, সেই রাজ্জাক এক সময় তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। আর আস্তে আস্তে তিনি হয়ে উঠেন এক মহানায়ক। আজকের মান্না।
১৯৮৬ সালে 'নায়করাজ' রাজ্জাকের এক বন্ধুর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত 'তওবা' সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন মান্না। এভাবেই শুরু হয় মান্নার চলচ্চিত্রজীবনের যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে আসলাম তালুকদার নাম পাল্টে হয়ে ওঠেন 'মান্না'। শুরুতে একের পর এক অ্যান্টি–হিরো হিসেবে অভিনয় করেছেন, কিন্তু সে সময় তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। আশির দশকে মান্না যখন একক ছবিতে অভিনয় শুরু করেন, সে সময় রাজ্জাক, আলমগীর, জসীম, ফারুক, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনের নায়ক হিসেবে বেশ সফল । এই দাপটে অভিনেতাদের মধ্যে ছিল 'তওবা', 'পাগলী', 'ছেলে কার', 'নিষ্পাপ', 'পালকি', 'দুঃখিনী মা', 'বাদশা ভাই' এই রকম সফল চলচ্চিত্র। দুঃখের ব্যাপার হলো, এসব চলচ্চিত্রে মান্না প্রধান নায়ক হিসেবে না থাকলেও তার সাফল্যে যাত্রা অনবরত সামনের দিকে শুরু হতে থাকে।
নায়ক মান্না অভিনীত প্রথম ছবি 'তওবা' হলেও প্রথম মুক্তি পেয়েছিল 'পাগলী' নামের এই ছবিটি। তার জীবনে প্রথম ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত 'কাশেম মালার প্রেম' ছবিতে প্রথম একক নায়ক হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এই ছবিটি খুব জনপ্রিয় হওয়ার পরে একের পর এক ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন মান্না। এরপর কাজী হায়াতের 'দাঙ্গা' ও 'ত্রাস' ছবিতে তাঁর একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হয়ে গেল। এরপর আরও কয়েকটি ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়েছেন মান্না। দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর 'গরীবের বন্ধু' ছবির পর মান্না একটু ধীরে এগোতে থাকেন। সে সময় মান্নাকে নিয়ে সবার আগ্রহ তৈরি হয়। সবাই তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের প্রয়োজক-পরিচালকেরাও তাঁর কাছে নির্ভরতা খুঁজে পান।
নব্বই দশকের প্রারম্ভিক দিকে, নাঈম-শাবনাজ, সালমান শাহ-শাবনূর, ওমর সানী-মৌসুমী জোড়াটি অনেক সফল ছিল। তাদের পাশে মান্না ওপরে দাঁড়ানো ছিল। মনতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াত, নূর হোসেন বলাই, নাদিম মাহমুদ, এম এ মালেক, এফ আই মানিক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবু, এ জে রানা, বেলাল আহমেদ এমন অনেক পরিচালকরা তার ছবিগুলি দেয়ার মাধ্যমে মান্নার অভিনয়ের ক্ষমতা বা দক্ষতা প্রমাণ করতে তাঁর প্রতি আস্থা রাখতেন।
১৯৯৬ সালে সালমান শাহের হঠাৎ আচমকা মৃত্যুতে প্রযোজক-পরিচালকেরা দিশাহারা হয়ে গেলেন। কারণ, তখন সালমান শাহের প্রতি বিনিয়োগ অনেক বেশি ছিল। এই সময়ে পরিচালকদের চোখে একমাত্র আশার নায়ক হিসেবে মান্না উপস্থিত ছিল। মান্না নিষ্ঠার সাথে পূর্ণ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের কাঁধে তুলে ধরার কঠিন দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৯৭ সালে, নায়ক থেকে প্রয়োজনায় আসতেই মান্নার ক্যারিয়ারে একটি নতুন উল্লেখযোগ্য অধ্যায় শুরু হয়। তার প্রথম ছবি 'লুটতরাজ' অত্যন্ত জনপ্রিয় হিট হয়েছিল। এরপর বাংলাদেশে মান্না-অধ্যায়ের প্রয়োজনার পরিধি চালু হয়। অনেক ছবি মুক্তি পেতে থাকলেও, তাঁর অভিনয় দ্বারা ব্যবসার সাথে সাথে অত্যন্ত প্রশংসিত হতে থাকে। বেশিরভাগ ছবিই অবশ্য দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং ব্যবসায়িক সাফল্যও অর্জন করেছিল। প্রয়োজক-পরিচালকরা তাঁকে নিয়ে একটি নতুন আশার আলো সৃষ্টি করেন এবং তাঁর অবদানের জন্য ধন্যবাদ প্রদান করেন। মান্না একের পর এক ছবি বানাতে থাকার পাশাপাশি তাঁর প্রয়োজনার প্রতি অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর প্রয়োজনা প্রতিষ্ঠান থেকে যত ছবি প্রয়োজনা করেছিলেন, প্রতিটি ছবি অত্যন্ত ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করেছিল। এই ছবিগুলি 'লুটতরাজ', 'লাল বাদশা', 'আব্বাজান', 'স্বামী–স্ত্রীর যুদ্ধ', 'দুই বধূ এক স্বামী', 'মনের সাথে যুদ্ধ' এবং 'মান্না ভাই' হলো অন্যতম।
কীভাবে মান্না এত প্রশংসিত হতে পারেন, এই প্রশ্নে দেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই একমত ছিলেন যে মান্নাকে দর্শকদের সবসময় পরিচিত মনে হতো। বহুল প্রশংসিত চরিত্র, যারা সত্যজ্ঞ, মনোমানো ও মৃদু স্বরে কথা বলে, সাধারণত বাস্তব বা আদর্শময় ছাত্র বা ভদ্রলোক নায়ক হিসেবে প্রদর্শিত হতেন, মান্না সবসময় যে চিত্রগ্রহণকারী রূপে প্রদর্শিত হতেন। কোনও চলচ্চিত্রে মান্না অধিকাংশই ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় দর্শকের কাছে প্রদর্শিত হতেন। এক সময় তিনি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে লড়াইরত সৎ পুলিশ অফিসার, অসহায় গরীবের কষ্ট মিটাতে নিয়োজিত প্রতিবাদী যুবক, অন্য সময় সম্পত্তির প্রতি দমনকারী রবিনহুট । চলচ্চিত্রে এই সমস্ত চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে সমাজের অসহায় বর্গের দর্শকরা উপস্থিতি অনুভব করে, তাদের মধ্যে শান্তি ও আনন্দ উৎপন্ন হয়। এই ছবিতে মান্না সাধারণত সমাজের নিম্নবর্গের দর্শকদের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
স্বাধীনতার পর প্রায় নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত ঢাকার বৃহত্তর অংশ চলচ্চিত্রের নায়কদের মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তারা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল পেতো, ভালো চাকরি করতেন। কিন্তু মান্নার চরিত্রগুলো সেই ধরণের ছিল না। তাঁর চরিত্রটি সাধারণত হতো উঁচু ধ্বনিতে কঠোর, যুবকের ধারালো অস্থিরতা অবদান করে। সংসারে তার সাফল্যের মাপকাঠি হতো সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের পরাজিত করা। এই কারণেই খুব সহজেই মানুষের হৃদয়ে প্রিয়তম হয়ে উঠেছিলেন মান্না।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত বিভিন্ন কার্যক্রমেও মান্না একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা প্রবেশ করার সময়ে মান্না একটি মুখ্য ভূমিকা রাখেন। দেশে অশ্লীল ছবি হতে থাকে অনেক। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই ধরনের চলচ্চিত্রের আকর্ষণ ছিল। অন্যদিকে, কিছু ভালো চলচ্চিত্রে অশ্লীল দৃশ্যের মধ্যে অবিলম্বে অবদান রেখেছেন অনেকে। তবে মান্না এই ধরণের অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধভাবে লড়াই করেছিলেন। অতএব, অশ্লীল চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের সঙ্গে তিনি লড়াই করে তার এই সাহসিক লড়াই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে উঠেন। এই সময়ে মান্নার চলচ্চিত্রগুলি মাত্র প্রযোজক এবং পরিচালকদের আশার আলো, ব্যবসায় টিকে থাকার সাহস ধারণ করেছিল। তার মৃত্যুর আগে মান্না একাধিক মুখোমুখি হতেন।
আশির দশকে সুনেত্রা, নিপা মোনালিসা, চম্পা, দিতি, রোজিনা, নূতন, অরুণা বিশ্বাস এবং কবিতা মতো সিনিয়র নায়িকাদের সঙ্গে মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা, মুনমুন, সাথী, স্বাগতা, শিল্পী, লিমা এই ধরনের সবার সাথে যেমন সফলতা অর্জন করেছিলেন, ঠিক তেমনি তাঁর ছবিগুলি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছে। তাঁর অভিনীত ছবিগুলি দৃশ্যমাত্রে অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছে এবং সেগুলি তার আবেগনাত্মক সাহসের সাথে লোকের মনে থাকবে। এককালে, ছবিতে মান্না অভিনীত করছেন, এই কারণেই দর্শকরা ছবিতে আকর্ষিত হতেন। মান্না যেসময় ছবিতে অভিনয় করতেন, সেই ছবি সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতেন, চাইতে না চাইতে। তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নির্ভরশীল ছবিগুলিতেও মান্না অসংখ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
প্রায় ১৬ বছর আগে, এই দিনে, নায়ক মান্না আকস্মিকভাবে পৃথিবীতে প্রস্থান করেন। ঘটনাটি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছিল। শুটিং করা সময়ে এই দুর্ভাগা ঘটনাটি ঘটে। এই ঘটনায় মান্না দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি ১৬ তারিখ। শুটিং শেষে বাড়িতে ফিরে এসেই মান্না বুকে অতিশয় ব্যথা অনুভব করেন। গৃহ সহকারী মিন্টু পানি এনে তাকে খাওয়ালেন। একটু হাঁটাহাঁটি করে পরে তিনি ঘুমান। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আবার সেই ব্যথা। মিন্টুকে ঘুম থেকে উঠে নায়ক মান্না বললেন, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। হাসপাতালে যাব। বুকের ব্যথাটা বাড়ছে।’ নিজেই গাড়ি চালানোর পর উত্তরা থেকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চলে যান। কিন্তু ফিরে আসা হল তিনি প্রাণহীন হয়ে। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মান্না চলে গেলেন। সমস্ত জগত অবাক হয়ে উঠল শোক ও বেদনার সঙ্গে। ঢালিউডের জনপ্রিয় নায়ক মান্না ইহজাগতিক ভ্রমণের পর অনন্তকালীন জায়গায় পারি জমালেন।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"